Header Ads

Header ADS

পিরিওড বা মাসিক ঋতুচক্র সম্পর্কে জেনে নিন

মেয়েদের বয়ঃসন্ধির পর থেকে প্রায় প্রতি ২৮ দিন অন্তর অন্তর দুটো ডিম্বাশয়ের কোন একটি থেকে একটি ডিম্বাণু নির্গত হয়ে ফ্যালোপিয়ান নলের মধ্যে দিয়ে জরায়ুর দিকে যাত্রা শুরু করে। ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গমনের এই ঘটনাকে বলা হয় ওভিউলেশন।

যদি নির্গমনের দুই থেকে তিনদিনের মাঝে ফ্যালোপিয়ান নলের মধ্যে শুক্রাণুর (যা যৌন সঙ্গমের ফলে অথবা কৃত্রিম উপায়ে প্রজননের ফলে আসতে পারে) সাথে ওই ডিম্বাণুর নিষেক না ঘটে তবে ওই ডিম্বাণুটি শুকিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে প্রায় দুসপ্তাহ পরে তা যোনির মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে যায়। ডিম্বাণুর সাথে সাথে জরায়ুর ভেতরের দেওয়ালের আস্তরণ (যার নাম এন্ডোমেট্রিয়াম) থেকে কিছু পরিমান টিস্যু এবং রক্তও যোনির মাধ্যমে কয়েকদিন ধরে ধীরে ধীরে বের হয়।

যোনির মধ্যে দিয়ে ডিম্বাণু, রক্ত ও টিস্যু নির্গমনের এই ঘটনাকে বলা হয় রজঃস্রাব বা ঋতুস্রাব বা menstrual flow। একে অনেক সময় চলতি কথায় বলা হয় যে “পিরিওড হচ্ছে”; যদিও এটা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে পরপর দুবার রজঃস্রাব বা menstrual flow শুরু হবার মধ্যবর্তী সময়কালকেই বলা হয় পিরিওড বা মাসিক ঋতুচক্র। সাধারণত গড়ে এই সময়ের দৈর্ঘ্য ২৮ দিন, তবে ব্যক্তিবিশেষ এবং প্রজনন ব্যাধির উপর নির্ভর করে এর ব্যপক তারতম্যও লক্ষ করা যায়। (প্রজনন ব্যাধি সম্মন্ধে আমরা অন্যত্র আলোচনা করব)।

প্রতি পিরিওডের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ রজঃস্রাব (রক্ত ও টিস্যু নির্গমণ) শুরু হবার প্রায় ১৪ দিন পর ওভিউলেশন ঘটে। পিরিওড বা ঋতুচক্র প্রত্যেক সুস্থ নারীর জীবনের একটি অঙ্গ যা প্রজননের জন্য অপরিহার্য। সাধারণত গড়ে ১২ বছর বয়সে প্রথম রজঃস্রাব হয় এবং এই প্রক্রিয়া রজঃবন্ধ বা মেনোপজ পর্যন্ত (যা ৪০ থেক ৫০ বছর বয়েসে ঘটতে পারে) সক্রিয় থাকে।

তবে বংশগতি, খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য ইত্যাদির উপর নির্ভর করে রজঃস্রাব (পিরিওড) শুরু বা শেষ হওয়ার বয়স আলাদা হতে পারে। যেমন ৮ থেকে ১৬ বছর বয়সে প্রথম ঋতুস্রাব (পিরিওড) হওয়াকেও স্বাভাবিকের পর্যায়ে ফেলা হয়। প্রথম পিরিওড বা ঋতুচক্রকে কে বলা হয় আদ্যঋতু বা menarche।

পিরিওড বা ঋতুচক্রের বিভিন্ন দশা

চিত্র ১ – পিরিওড বা মাসিক ঋতুচক্রের বিভিন্ন দশা।

পাশের ছবিতে ঋতুচক্রের বিভিন্ন সময়ে ডিম্বাশয়, জরায়ু, হরমোনের মাত্রা ও দেহের তাপমাত্রার কেমন পরিবর্তন হয় তা দেখানো হয়েছে।

এই পরিবর্তনগুলির উপর নির্ভর করে পিরিওড বা ঋতুচক্রকে দুটি সমান্তরাল অংশে বিভক্ত করা যায় – ওভারিয়ান চক্র এবং ইউটেরাইন চক্র। নাম থেকেই স্পষ্ট যে প্রথমটি ডিম্বাশয়ের ও দ্বিতীয়টি জরায়ুর পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন বোঝায়। আমরা এর পরবর্তী আলোচনার সময় ধরে নেব যে পিরিওডের দৈর্ঘ্য ২৮ দিন।

প্রথমে দেখা যাক ডিম্বাশয়ের কি পরিবর্তন হয়। পিরিওড বা ঋতুচক্রের প্রথম থেকে ১৩ তম দিন পর্যন্ত ডিম্বাশয়ের দশাকে বলা হয় ফলিকিউলার দশা। এই সময় ডিম্বাশয়ে প্রায় ১০ থেকে ২৫ টি ফলিকল বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ফলিকলগুলি হল কোষ দিয়ে গঠিত গোলাকার থলের মত অংশ।

প্রতিটি ফলিকলের মধ্যে একটি করে ডিম্বকোষ থাকে। পিরিওডের প্রায় এক সপ্তাহ পর থেকে ওই ফলিকলগুলির মধ্যে সবথেকে বড় ফলিকলটি আরও বৃদ্ধি পেয়ে পরিণত বা গ্রাফিয়ান ফলিকলে রূপান্তরীত হবার সুযোগ পায় (বাকিগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যায়)। ফলিকলগুলি নিজেরাই ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন ও ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরণ করে যারা ফলিকলের বৃদ্ধি ও পরিণতি প্রাপ্তির জন্য দায়ী। পিরিওডের ১৪ তম দিনে ওভিউলেশন ঘটে, অর্থাৎ গ্রাফিয়ান ফলিকলটি ফেটে গিয়ে তার থেকে ডিম্বাণু বেরিয়ে আসে।

এর সাথে সাথে ফলিকলের মধ্যবর্তী তরল পদার্থও বেরিয়ে আসে যা ডিম্বাণুটিকে ডিম্বাশয়ের বাইরে বের হতে সহায়তা করে। ওই সময় রক্তরসে লিউটেনাইজিং হরমোনের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ফলেই এই পুরো ঘটনা (ওভিউলেশন) সংঘটিত হয়। ফেটে যাওয়া ফলিকলটি এরপর কর্পাস লুটিয়াম নামের একটি গ্রন্থিতে রূপান্তরিত হয় যা পিরিওডের অবশিষ্ট সময় ধরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন ক্ষরণ করে।

ওভিউলেশন থেকে পিরিওডের শেষ দিন পর্যন্ত সময়কে বলা হয় লুটিয়াল দশা। ওভিউলেশনের পরে ডিম্বাণুটি ফ্যালোপিয়ান নলের মধ্যে দিয়ে জরায়ুর দিকে অগ্রসর হয়। যদি ফ্যালোপিয়ান নলে শুক্রাণুর সথে নিষেক হয় তবে নিষিক্ত ডিম্বাণু গিয়ে জরায়ুতে স্থাপিত হবে। আর যদি তা না হয় তবে ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে রজঃস্রাবের মাধ্যমে দেহ থেকে নির্গত হবে।

জরায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তনকে তিনটি দশায় ভাগ করা যায়। পিরিওড বা ঋতুচক্রের প্রথম পাঁচ দিনকে বলা হয় মেন্সট্রুয়াল দশা। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই সময় রজঃস্রাব হয়। এই দশায় ডিম্বাশয়ের কর্পাস লুটিয়াম গ্রন্থি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রক্তরসে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যায়, যার ফলে জর়ায়ুর ভেতরের আস্তরণ বা এন্ডোমেট্রিয়ামের টিস্যু খসে যায়।

প্রকৃতপক্ষে প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ায় জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামের সব থেকে বাইরের স্তরের রক্তবাহগুলি সঙ্কুচিত হয়ে রক্তপ্রবাহে বাঁধা প্রদান করে, যাতে সেখানকার টিস্যুগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এই মৃত টিস্যুগুলি সহজেই এন্ডোমেট্রিয়াম থেকে আলাদা হয়ে খসে যেতে থাকে।

উপরন্তু ওই টিস্যুগুলি খসে যাওয়ার ফলে সেখানকার রক্তবাহী জালিকাও ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। রক্ত ও মৃত টিস্যুই রজঃস্রাবরূপে যোনির মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যায়। এর সাথে অবশ্যই নষ্ট ডিম্বাণু্টিও বের হয়। পিরিওডের ষষ্ঠ দিন থেকে শুরু হয় এন্ডোমেট্রিয়ামের গঠনমূলক বা বিস্তার দশা (proliferative phase)। এই দশায় জরায়ু পুণরায় গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয়। রজঃস্রাবের পরে অবশিষ্ট এন্ডোমেট্রিয়ামের টিস্যু ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে এই দশায় আবার বৃদ্ধি পায় এবং সেখানে রক্তবাহের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।

এছাড়াও সারভিকাল গহ্বর (servical canal) থেকে এক ধরনের পাতলা মিউকাস বের হয় যার উদ্দেশ্য শুক্রাণুকে বেঁচে থাকতে ও চলতে সহায়তা করা। ওভিউলেশনের পর থেকে পিরিওডের শেষ পর্যন্ত দশাকে (১৫ থেকে ২৮ তম দিন) বলা হয় ক্ষরণকারী দশা বা secretory phase। এই দশার নিয়ন্ত্রক হরমোন হল কর্পাস লুটিয়াম থেকে ক্ষরিত প্রোজেস্টেরণ হরমোন।

এই সময় জরায়ু গর্ভধারণ ও গর্ভষ্ঠ ভ্রূনের পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য পুরোমাত্রায় তৈরি হয়। এন্ডোমেট্রিয়ামে রক্তসরবরাহ বেড়ে যায়, এর ভেতরের আবরণ পুরু হয় এবং এখান থেকে গ্লাইকোজেন সমৃদ্ধ রস ক্ষরণ শুরু হয়। যদি নিষেক না ঘটে তবে এই দশার শেষে কর্পাস লুটিয়াম নষ্ট হয়ে গিয়ে প্রোজেস্টেরনের মাত্রা কমে যায় এবং তার ফলস্বরূপ পুণরায় রজঃস্রাব শুরু হতে পারে (যা পরবর্তী মাসিকের সূত্রপাত)।

আর যদি নিষেক ঘটে তবে জরায়ুতে প্রোথিত ভ্রূন থেকে HCG হরমোন ক্ষরিত হয়ে কর্পাস লুটিয়াম গ্রন্থিকে বাঁচিয়ে রাখে (যতদিন পর্যন্ত অমরা বা প্লাসেন্টা থেকে প্রোজেস্টেরন ক্ষরণ শুরু না হচ্ছে ততদিন), যাতে তা প্রোজেস্টেরন হরমোন ক্ষরণ করতে থাকে। জরায়ুর ভেতেরের আস্তরণ ঠিকঠাক রাখতে প্রোজেস্টেরন হরমোন একান্ত অপরিহার্য এবং গর্ভস্থ ভ্রূনের জন্য জরায়ুর ভেতরের আবরণ অবশ্য প্রয়োজনীয়।

No comments

Powered by Blogger.